ডাক বাতায়ন- পর্ব-০২
আরব্য রূপকথার টিভি সিরিয়ালগুলো বেশ জনপ্রিয় ছিল। সিন্দাবাদের ভ্রমণ কাহিনী, আলাউদ্দীনের চেরাগ, আলিবাবা চল্লিশ চোরের কাহিনী প্রভৃতি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখতাম আর রুপকথার অদ্ভুতুরে কাণ্ডকীর্তিগুলো মানসপটে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচালে দোদুল্যমান ছিল। সিন্দাবাদের অসম সমুদ্র পাড়ি দেওয়া,আলাউদ্দিনের চেরাগ ঘসে দৈত্য আনা বা আলীবাবার বুদ্ধিমত্তা আমাকে অবাক করত।
৪র্থ শিল্প বিপ্লবের এই যুগে তথ্য প্রযুক্তি কিন্তু আমাদের আলাউদ্দিনের দৈত্যের মতো নিমেষেই আমার চাহিত পন্য হাজির করছে। হ্যাঁ বলছি বর্তমান ই -কমার্সের যুগে যে কোন দেশের পন্য যে কোন দেশ থেকে ক্রয় বা বিক্রয়ের কথা।বর্তমান প্রজন্ম হয়ত আরব্যোপন্যাসের আলীবাবার কথা জানে না কিন্তু পন্যের বাহার সাজিয়ে বসা আলীবাবা বা আমাজন ডট.কম এর সাইটে তাদের একবার ঢুঁ না মারলে চলে না।
তথ্য প্রযুক্তি যেমন বিদেশী পন্যসমূহকে হাতের নাগালে নিয়ে এসেছে তেমনি দেশী পন্যের বাজারও বিদেশে সম্প্রসারণের সুযোগ দিয়েছে। একটা ক্লিকেই এখন পন্য কেনাবেচা হচ্ছে। কিন্তু ফিজিক্যাল পন্য কম খরচে ও নিরাপদে ক্রয়কারীর নিকট পৌঁছাতে প্রয়োজন পরিবহন মাধ্যম। এক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হিসেবে ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়নের পরিবহন মাধ্যমের বিকল্প এখনো তৈরী হয়নি। আজকে ইউপিইউ এর সদস্য বাংলাদেশ ডাক বিভাগের বিভিন্ন দেশের ডাক দ্রব্য পরিবহন সম্পর্কে কিছু তথ্য সম্মানিত গ্রাহকগনের জ্ঞাতার্থে উপস্থাপন করা হলো।
বাংলাদেশ ডাক বিভাগ একটি আন্তর্জাতিক অরগানাইজেশান ইউপিইউ এর সদস্য।পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সাথেই ডাক আদান প্রদান হয়ে থাকে।মূলত তিনটি সার্ভিসের মাধ্যমে বিদেশের সাথে আমরা ডাক আদান প্রদান করে থাকি।
ইএমএস(এক্সপ্রেস মেইল সার্ভিস)ঃ পৃথিবীর প্রায় ৫৭ টি দেশের সাথে এই সার্ভিস চলমান রয়েছে।সাধারণত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে এয়ারের মাধ্যমে ডাক আদান প্রদান হয়ে থাকে। এই ডাক পৌঁছাতে বা আসতে ১০-২০ দিন সময় লাগতে পারে।
আন্তর্জাতিক এয়ার পার্সেলঃ পৃথিবীর প্রায় ১৮১ টি দেশের সাথে এই সার্ভিস রয়েছে।সাধারণত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে এয়ারের মাধ্যমে ডাক আদান প্রদান হয়ে থাকে। এই ডাক পৌঁছাতে বা আসতে ১৫-২২ দিন সময় লাগতে পারে।
সার্ফেস পার্সেলঃ পৃথিবীর প্রায় ১৭৪ টি দেশের সাথে এই সার্ভিস রয়েছে।এই পার্সেল সমূহ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দিয়ে সাগরের মাধ্যমে আদান প্রদান হয়ে থাকে। এই ডাক পৌঁছাতে বা আসতে ৬০-৭৫ দিন সময় লাগতে পারে।
ডাক আসার প্রক্রিয়াঃ
বিদেশ থেকে ডাক দ্রব্য ইএমএস ও এয়ার পার্সেল এর ক্ষেত্রে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর মাধ্যমে এয়ারপোর্টের ডাক বাছাই কেন্দ্রে আসে।অতঃপর ডাক দ্রব্যটি ঢাকা জিপিওতে অবস্থিত বৈদেশিক ডাক অফিসে পৌঁছায়।বৈদেশিক ডাক আগত পার্সেল সমূহ পরীক্ষা করার জন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করে।কাস্টমস কতৃপক্ষ ডাক দ্রব্য বিলি উপযোগী কিনা, ডিউটি উপযোগী কিনা তা পরীক্ষা করে।বিলি উপযোগী না হলে অর্থাৎ নিষিদ্ধ পন্য হলে তা আটক করে। আর বিলি উপযোগী হলে নির্ধারিত সরকারী রেট অনুযায়ী ডিউটি আরোপ করে স্লিপ সমেত ডাক দ্রব্যটি পুনরায় প্যাকেট করে বৈদেশিক ডাকের নিকট ফেরৎ দেয়। কাস্টমস থেকে আগত ডাক দ্রব্য বৈদেশিক ডাক ঠিকানা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠিয়ে দেয়। একই প্রক্রিয়া অনুসরণ হয় সাগরের মাধ্যমে যে ডাক আসে তার ক্ষেত্রে শুধু চট্রগ্রামে বৈদেশিক ডাকের অফিস ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এই কাজটি করে থাকে।
ডাক যাওয়ায় প্রক্রিয়াঃ ইএমএস বা এয়ার পার্সেল দেয়ের যে কেন প্রান্তে বুকিং এর পর ঢাকা বৈদেশিক ডাক অফিসে পৌঁছায় সেখানে স্ক্যানিং এর পর ঢাকা এয়ারপোর্ট ডাক বাছাই কেন্দ্রের মাধ্যমে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ হয়ে বিভিন্ন এয়ার লাইন্সের মাধ্যমে ডেসটিনেশন কান্ট্রিতে প্রেরণ করা হয়। সারফেস বা সি মেইলের ক্ষেত্রে সারাদেশ হতে চট্টগ্রাম বৈদেশিক ডাক অফিসে পৌঁছায় অতঃপর স্ক্যানিং এ যোগ্য ডাকদ্রব্য জাহাজের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর হয়ে ডেসটিনেশন কান্ট্রিতে পৌঁছায়।
রেট বা চার্জ কত?
আসলে এই ডাক দ্রব্যসমূহ রেট দেশ,ওজন ও সার্ভিসের ধরনভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়।তাই এই সল্প পরিসরে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়।তবে পৃথিবীর কয়েকটি অঞ্চলের কয়েকটি দেশের রেট সম্পর্কে ধারণা দেয়া হলো যাতে গ্রাহকগণ সহজেই বুকিং এর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট পোস্ট অফিসে যেতে পারেন। অন্যান্য দেশের চার্জ প্রায় একই রকম তাছাড়া ইএমএস এর দেশ ও ওজন ভিত্তিক রেট বা চার্জ গণনা ডাক অধিদপ্তর এট ওয়েবসাইটে দেয়া আছে।
ইএসএস /এয়ার পার্সেল/সারফেস পার্সেল তিন ধরণের সার্ভিসের ক্ষেত্রেই ২০ কেজির উপর প্যাকেটে করা যাবে না। আমেরিকাতে পাঠাতে ২০ কেজির ইএমএস করতে ২৬৩০০.৫০টাকা,এয়ার পার্সেল করতে ১৬৬৭০ টাকা এবং সারফেস মেইল বা সী পার্সেলের জন্য ৬৭৫০ টাকা খরচ পড়বে। কানাডার ক্ষেত্রে ৩০১৮৭.০০টাকা,১৬৮৭০টাকা,৬৩৬০ টাকা;জাপানের ক্ষেত্রে ১৫৫২৫ টাকা,৯৪১০ টাকা,৩৭৮০ টাকা;মালয়েশিয়া ক্ষেত্রে ১৩২০২ টাকা,৭২০০ টাকা২৬৫০ টাকা ; জার্মানীর ক্ষেত্রে ১৯৯৭২ টাকা,১২৪০০ টাকা,৬৬৬০ টাকা;অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে ১৮৮২৫.৫০ টাকা,১৩৫০০ টাকা,৪০৯০ টাকা;গ্রেট ব্রিটেনের ক্ষেত্রে ১৯৮৬০.৫০ টাকা,১২২০০ টাকা,৬৬৬০ টাকা খরচ পড়বে।
আবার ১ কেজির একটি পার্সেল আমেরিকাতে ইএমএস করতে ৩৫৭৬.৫০টাকা,এয়ার পার্সেল করতে ২২৩০ টাকা এবং সারফেস মেইল বা সী পার্সেলের জন্য ১৪৩০ টাকা খরচ পড়বে। কানাডার ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৩৮৩২.৫০টাকা,২৪৩০টাকা,১৪২০ টাকা;জাপানের ক্ষেত্রে ২৩৪৭.৫০ টাকা,১৪৩০ টাকা,৯৩০ টাকা;মালয়েশিয়া ক্ষেত্রে ১৮৪০ টাকা,১১২০ টাকা ৭৫০ টাকা ; জার্মানীর ক্ষেত্রে ৩১৮০.৫০ টাকা,২১৪০ টাকা,১৫৩০ টাকা;অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে ৩০৯৩.৫০ টাকা,১৭২০ টাকা, ১০৫০ টাকা;গ্রেট ব্রিটেনের ক্ষেত্রে ৩১৬৯ টাকা,১৯৪০ টাকা,১৫৩০ টাকা খরচ পড়বে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে ছোট আকারের পার্সেল করার জন্য ( ২৫০ গ্রামের নিচে) ইএমএস করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে কেননা এই সার্ভিসটি অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতির। আর যদি ১ কেজি পরিমান পার্সেল হলে এয়ার পার্সেল করা সুবিধাজনক কেননা অপেক্ষাকৃত সস্তা ও দ্রুতগতির। পার্সেল যদি বড় হয় এবং সময় নিয়ে যদি কারও কোন সমস্যা না থাকে তাহলে সারফেস মেইল এর সার্ভিসটি নিয়ে দেখতে পারেন।
কিছু প্রশ্নোত্তর
ডাক বিভাগে চাকুরির সুবাদে গ্রাহকগণ প্রায়শঃই কিছু প্রশ্ন বা সাজেশন দিয়ে থাকে। এবার একটু সেগুলো আলোকপাত করা যাক।
১। সারফেস মেইল এত সস্তা কিন্তু সময় লাগে আড়াই মাস এটা কি কমানো যায় না?
উঃ হ্যাঁ যায় এটা ৩০ দিনের মধ্যে ডেসটিনেশন কান্ট্রিতে পৌঁছানো সম্ভব। যদি আমাদের ১৫০০- ২০০০ কেজি কন্টেনার পূর্ণ জন্য পর্যাপ্ত মেইল সারাদেশ থেকে প্রতিদিন বুকিং করা হয়। অর্থাৎ সারফেস মেইল এর বুকিং বাড়লে অটোমেটিকালি সময় কমে আসবে।
২। ডিএসএল/ ফেডেস্ক ৩-৫ দিনে পন্য পৌঁছায় আপনাদের ইএমএস ১০-১৫ দিন লাগে কেন?
উঃ ডিএসএল বা ফেডেক্স এর মতো কুরিয়ার সার্ভিসের বিশ্বের প্রায় সকল দেশে নিজস্ব জনবল রয়েছে ফলে তাদের পার্সে তারা নিজেরা ডিল করতে পারে এবং কমপ্লেইন ম্যানেজম্যান্টও নিজেদের উপর নির্ভরশীল এজন্য তথ্য প্রাপ্তিতে কোন সমস্যা হয় না।অন্যদিকে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ডাক পরিবহনের ক্ষেত্রে দেশের গন্ডি পার হওয়ার পর অন্য দেশের ডাক প্রশাসনের উপর নির্ভরশীল ফলে সকল দেশের সার্ভিস স্যান্ডার্ড একরকম না হওয়ায় তথ্য প্রাপ্তি ও ডাক দ্রব্য হ্যান্ডেলিংএ একেক দেশের একেক রকম সময় লাগে।
৩।সকল ডাক চার্জ পরিশোধ করার পরও বিদেশ থেকে পার্সেল আসলে দেশের পোস্টম্যানকে টাকা দিতে হয় কিন্তু বিদেশে কোন পার্সেল পাঠালে পার্সেল গ্রহীতাকে কেন মূল্য পরিশোধ করতে হয় না কেন?
উঃ আগেই বলা হয়েছে বিদেশি পার্সেল দেশে আসলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাস্টমস বিভাগ সরকারী রেট অনুযায়ী ডিউটি আরোপ করে যেটা পোস্টম্যান সংশ্লিষ্ট প্রাপকের নিকট হতে আদায় করে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে কাস্টমস বিভাগে প্রেরণ করে এই চার্জের বিষয়ে পোস্ট অফিসের কোন হাত নেই। তবে পার্সেলর গায়ে লিখা চার্জের বেশি দাবি করলে সংশ্লিষ্ট পোস্ট অফিসে অভিযোগ করবেন আমরা ব্যবস্থা নিবো এক্ষেত্রে ডাক বিভাগ জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাসী। আর বিদেশে পার্সেল গেলে বিশেষ উন্নত কান্ট্রিগুলোতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ছোট ছোট পন্যের উপর ডিউটি আরোপ করে না। আসলে ডিউটি আরোপ এটা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের কাস্টমস আাইনের উপর।
৪। বিদেশ থেকে পার্সেল আসলে মাঝে মাঝে জিপিওতে গিয়ে পার্সেল আনতে হয় কেন?
উঃ যদি কোন নিষিদ্ধ পন্য যা বাংলাদেশের যেখানে কাস্টমস আইনের পরিপন্থী সেক্ষেত্রে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পন্যটি আটক করে এবং প্রাপকে নোটিশ পাঠায়। প্রাপক এসে প্রেসক্রিপশন বা উপযুক্ত প্রমান দাখিল করতে পারলে অনেক সময় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ছাড় প্রদান করে। এক্ষেত্রে অযাচিত হয়রানির বিষয়ে ডাক কর্তৃপক্ষের কোন হাত নাই।
৫। আপনাদের বিদেশি ডাক পন্যগুলো কি ট্র্যাক করা যায়।
উঃ আমাদের ইএমএস /এয়ার পার্সেল বা সারফেস পার্সেল এর সবগুলো আইটেমই ট্র্যাক এন্ড ট্র্যাস এর আওতায় মধ্যে রয়েছে। ফলে আপনি ঘরে বসেই আপনার ডাকদ্রব্যের তথ্য জানতে পারবেন।
আন্তরিক ভাবে দুঃখিত আপনাদের দীর্ঘ সময় নষ্ট করার জন্য। ডাকের সেবা নিন, গ্রাহকের সন্তুষ্টি বিধান করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।
সঞ্জিত চন্দ্র পন্ডিত
ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল
ময়মনসিংহ বিভাগ।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস